যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ৩.৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক অনুদান নিশ্চিত করছে এবং ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিবছর অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের নিশ্চয়তা দিয়েছে
২৬টি দেশ অন্তত ১০ দফায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পাঠিয়েছে
১৯টি দেশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে
১৮টি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর তহবিল স্থগিত করেছবৈশ্বিক সহায়তা ছাড়া গাজার ‘নৃশংস গণহত্যা’ কখনোই সম্ভব হতো না বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ।
সোমবার প্রকাশিত তার সর্বশেষ প্রতিবেদন ‘গাজা জেনোসাইড : এ কালেক্টিভ ক্রাইম’-এ তিনি বলেন, ইসরাইল একা নয়, আরব-যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপসহ বিশ্বের ৬৩ দেশ মিলে গণহত্যা চালিয়েছে গাজায়। ২৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, এটি একটি সামষ্ঠিক অপরাধ যা এসব দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তায় টিকে আছে। মিডল ইস্ট আই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ক‚টনৈতিক সুরক্ষার কারণেই ইসরাইল আজও দায়মুক্তভাবে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারছে। আলবানিজ বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলকে শুধু রক্ষা করেই থেমে থাকেনি, তাদের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ভাষ্যেও এমন এক বর্ণনা প্রচারিত হয়েছে যা ইসরাইলকে ‘সভ্য রাষ্ট্র’ আর ফিলিস্তিনিদের ‘বর্বর’ হিসাবে তুলে ধরে। হামাস ও সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে পার্থক্য না করে ‘ইসরাইলি বয়ানকে তোতাপাখির মতো পুনরাবৃত্তি’ করেছে পশ্চিমা মিডিয়া।
আলবানিজ জানান, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সাতবার ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে ব্যাহত করেছে। ইসরাইলের জন্য ক‚টনৈতিক রক্ষাকবচ তৈরি করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র একা নয়Ñযুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসও প্রস্তাবগুলো দুর্বল বা বিলম্বিত করে সহযোগিতা করেছে।
অন্যদিকে আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানালেও ‘সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ’ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মিসর রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রেখেছে এবং ইসরাইলের সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা চালিয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু আঞ্চলিক দেশ ইসরাইলের জন্য বিকল্প স্থলপথের রুট খুলে দিয়েছে। যা লোহিত সাগর এড়িয়ে ইসরাইলের বাণিজ্য সহজ করেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে পশ্চিমাদের ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন আলবানিজ।
তিনি বলেন, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিকারাগুয়াকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) সহায়তা করেনি বরং এখনো পর্যন্ত তারা স্বীকার করছে না যে ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ আইসিজেতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার সরকারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আদালতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আর যুক্তরাজ্য অর্থায়ন বন্ধের হুমকি দিয়েছে।
জাতিসংঘ ১৯৭৬ সাল থেকেই ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহŸান জানালেও প্রতিবেদনটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালি ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ৩.৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক অনুদান নিশ্চিত করছে এবং ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিবছর অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে যুক্তরাজ্যও। ৬০০-এরও বেশি নজরদারি বিমান পাঠিয়েছে দেশটি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৬টি দেশ অন্তত ১০ দফায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পাঠিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বেশি অস্ত্র পাঠিয়েছে, চীন (তাইওয়ানসহ), ভারত, ইতালি, অস্ট্রিয়া, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও ফ্রান্স। এ ছাড়া ১৯টি দেশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে। এ তালিকায় রয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
স্পেন ও স্লোভেনিয়া অস্ত্রচুক্তি বাতিল ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ এখনো তা অব্যাহত রেখেছে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ও মরক্কোর মতো দেশ তাদের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে অস্ত্র সরবরাহ করার অনুমতি দিয়েছে।
এদিকে বেশকিছু দেশ ইসরাইলের তৈরি অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি কেনা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় যুদ্ধ চলাকালীন ইসরাইলের সামরিক রপ্তানি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। কিছু ইউরোপীয় দেশ যেমন : জার্মানি, পোল্যান্ড, গ্রীস, ইতালি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং সার্বিয়া গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যার সময় ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান এবং মরক্কোও বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে। কেবল তুরস্ক ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত করেছে। যদিও কিছু বাণিজ্য পরোক্ষভাবে অব্যাহত ছিল।
প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইসরাইলের অব্যাহত অভিযানে ৬৮,২০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। যুদ্ধের ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলেও পড়ে গাজা।
আলবানিজ বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনিরা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল সত্তে¡ও ইসরাইলের অভিযোগে ১৮টি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর তহবিল স্থগিত করেছে। তদন্ত অসম্পূর্ণ থাকলেও দাতা দেশগুলো পরে তহবিল পুনরায় চালু করে।
তিনি উলেখ করেন, কিছু দেশ ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে মূল সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা চালিয়েছে। যা বিপজ্জনক ও অকার্যকর। আলবানিজ বলেন, গাজায় গণহত্যামূলক সহিংসতা দৃশ্যমান হওয়ার পরও ইসরাইলকে সামরিক, ক‚টনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে বেশির ভাগ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো।

