আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে যে অসুখগুলো আমাদের ঘরে ঘরে নিঃশব্দে হানা দিচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। কর্মক্ষেত্রের চাপ, খাদ্যাভ্যাসে অনিয়ম ও বিশ্রামের অভাব—এই তিন আক্রমণে রক্তচাপের কাঁটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে থাকে।
চিকিৎসকরা একে ‘নীরব ঘাতক’ বলেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই এর নির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ থাকে না। অথচ শরীরের ভেতরে নীরবে ঘটে যেতে থাকে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক কিংবা কিডনির মারাত্মক ক্ষতি। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষুধপত্র এই রোগ মোকাবেলার প্রধান হাতিয়ার। তবে শুধু ওষুধের ওপর নির্ভর না করে জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন আনলেই রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের ঘরের রান্নাঘরে থাকা কয়েকটি সাধারণ উপাদানও এ ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়ক পাঁচটি ঘরোয়া উপায়—
১. লবণকে না বলুন
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড খাওয়া কমানো। শুধু রান্নায় কম লবণ দিলেই হবে না, বিপদ লুকিয়ে থাকে বাইরের কেনা খাবারেও। যেমন—চিপস, নোনতা বিস্কুট, চানাচুর, আচার, পাঁপড় ও বিভিন্ন ধরনের সস। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণ সোডিয়াম থাকে, যা রক্তচাপ দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। তাই বাড়তি নোনতা খাবার বর্জন করে কম সোডিয়ামযুক্ত খাবারের দিকে ঝুঁকতে হবে। চাইলে রান্নায় সাধারণ লবণের বদলে লো-সোডিয়াম লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. পটাশিয়ামের সঙ্গে বন্ধুত্ব

শরীরে সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে পটাশিয়াম অত্যন্ত কার্যকর। এই খনিজ উপাদান রক্তনালিকে শিথিল করে এবং অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। যেমন—কলা, ডাবের পানি, পালং শাক, মিষ্টি আলু, টমেটো, ডাল, শিম, বীন্স ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত এসব খাবার খেলে রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে সুবিধা হয়।
৩. মহৌষধ রসুন
রসুনের চিকিৎসাগত গুণ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বহু আগে থেকেই রসুন হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসুনের মধ্যে থাকা অ্যালিসিন নামক যৌগ নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বাড়ায়। নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালিকে প্রসারিত করে, ফলে রক্তপ্রবাহ সহজ হয় এবং রক্তচাপ কমে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে কিংবা রসুন রান্নায় নিয়মিত ব্যবহার করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
৪. শরীরচর্চা অভ্যাসে আনুন

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে শরীরচর্চার ভূমিকা অপরিসীম। জিমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কসরত করার দরকার নেই। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং, দৌড়ানো বা সাঁতার কাটা—এমন সাধারণ ব্যায়ামই যথেষ্ট। নিয়মিত ব্যায়ামে হৃদযন্ত্র শক্তিশালী হয়, ধমনীর নমনীয়তা বাড়ে এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। এর ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে আসে। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণ করতেও শরীরচর্চা দারুণ কার্যকর, যা উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে আরেকটি বড় সহায়ক বিষয়।
৫. মানসিক চাপ কমান
মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা থাকলে শরীরে অ্যাড্রেনালিনসহ কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়, যা সাময়িকভাবে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ থাকলে তা স্থায়ীভাবে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি তৈরি করে। তাই মানসিক চাপ কমাতে প্রতিদিন কয়েক মিনিট ধ্যান, প্রাণায়াম বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করতে পারেন। পাশাপাশি প্রিয় গান শোনা, বই পড়া, বাগান করা বা পরিবার-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানো—এসব অভ্যাস মনকে শান্ত রাখে, রক্তচাপও স্বাভাবিক রাখে।
শেষকথা

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঘরোয়া উপায়গুলো অনেক কার্যকর হলেও এগুলো কোনোভাবেই চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের বিকল্প নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই রক্তচাপের ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়। জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা আনা, সুষম আহার, নিয়মিত ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণের সমন্বয়েই এই নীরব ঘাতককে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।