গাজায় যুদ্ধবিরতির তিন দিন পর মোহাম্মদ নূর ও তার পরিবার খান ইউনিস থেকে গাজা সিটিতে ফিরে আসেন। ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ি-ঘর। এরপর উপায় না পেয়ে আল-শিফা হাসপাতালের পেছনে একটি তাঁবু ফেলেন তারা। চারপাশজুড়ে ছিল ধ্বংসযজ্ঞ আর ধুলো। একদিন আগুন জ্বালানোর জন্য নূর তার ছেলেকে কার্ডবোর্ড আনতে বলেন। ধ্বংসস্তূপে কাঠ খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই গভীরভাবে আহত হন নূরের ১১ বছরের ছেলে ও দুই ভাগনে। ইসরাইলের ফেলা হাজার হাজার অবিস্ফোরিত বোমা গাজাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অবরুদ্ধ গাজা এখন ‘মাইনের শহরে’ পরিণত হয়েছে।
গাজায় শিশুরা কাঠ বা খাবারের খোঁজে বেরোলে, অনেক সময়ই মাইনের ওপর পা দিচ্ছে, ফলে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। জাতিসংঘও সতর্ক করেছে, গাজায় এখন প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ, প্রতিটি রাস্তা, এমনকি বাড়ি-ঘরের ভেতরেও আছে বিস্ফোরণের ঝুঁকি। মানুষ যখন ঘরে ফেরার চেষ্টা করছে বা পুনর্গঠন শুরু করছে, তখন এই অবিস্ফোরিত অস্ত্রগুলো তাদের জীবনের নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নূর বলেন, ‘আমি দেখলাম বিস্ফোরণে বাচ্চাদের দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে দেখি আমার ছেলে আর ভাইবোনের ছেলেরা সবাই বেড়ার ওপর ঝুলে আছে। অবস্থা ছিল ভয়ানক।’ নূরের বোন ঘাদির আল-আনকার ছুটে এসে দেখেন, তার ছেলেও রক্তে ভেসে আছে। আহত শিশুদের সবাইকে আল-শিফা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ড্রপসাইটে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, নূরের ছেলে জেইনের শরীরে ছোপ ছোপ ক্ষতের চিহ্ন, পায়ের হাড় আলাদা হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (ইউএনএমএএস) জানায়, ওইদিন পাঁচ শিশু অবিস্ফোরিত বোমার কারণে আহত হয়। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংস্থাটি বলেছে, যুদ্ধবিরতির পর গাজায় বিপুল পরিমাণ অবিস্ফোরিত অস্ত্র রয়ে গেছে। জানা যায়, অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুধুমাত্র অবিস্ফোরিত বোমায় অন্তত ৫২ ফিলিস্তিনি নিহত ও ২৬৭ জন আহত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা।
ইউএনএমএএস প্রধান লুক আরভিং জানান, ‘গাজা এখন কার্যত এক মাইনফিল্ড। ইসরাইল গাজায় যে ১০ হাজার টন বোমা ফেলেছে তা লন্ডন, ড্রেসডেন ও হামবুর্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেলা মোট বোমার চেয়েও বেশি।’ তাদের অনুমান, গাজায় নিক্ষিপ্ত অস্ত্রের ৫-১০ শতাংশ এখনো বিস্ফোরিত হয়নি।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারজৎ জানিয়েছে, এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ইসরাইলি বিমানবাহিনী অন্তত ৩,০০০ অবিস্ফোরিত বোমার কথা জানত। ইউএনএমএএস এখন পর্যন্ত ৫৬০টি এমন অস্ত্র শনাক্ত করেছে। তবে তারা বলেছে, পূর্ণ জরিপ না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।
গাজা সিটিতে এখনো ভাঙা সড়কে বুলডোজার কাজ করছে। পুরুষরা ধ্বংসসস্তূপে কাঠ ও প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজছে। স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মুশতাহা বলেন, ‘দ্বিতীয়বার ফিরে এসে দেখি সবকিছু একদম ধ্বংস। ভয়ানক দৃশ্য রাস্তা বন্ধ, চারপাশে ধাতু আর বোমার অবশিষ্টাংশ।’ গাজায় এখনো ন্যূনতম মানবিক সাহায্যও ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরাইল। ফলে অবিস্ফোরিত বোমাগুলো অপসারণ শুরু করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, ‘গাজায় বর্তমানে প্রায় ৭১,০০০ টন বিস্ফোরক রয়েছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটি শিশুদের অসাবধানতা বা উদ্ধারকাজের সময়েও হতে পারে। বাসাল আরও জানান, ইসরাইল গাজায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের ৯০ শতাংশ সদস্যকে হত্যা করেছে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ধ্বংস করেছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ দল ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন এই বিপদ সামলাতে। এগুলো না সরানো পর্যন্ত চরম ঝুঁকিতে থাকবে গাজা।
ক্ষুধা-শীতে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনিরা
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও গাজায় দুর্ভোগ কমেনি ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইলি অবরোধে ক্ষুধা ও চিকিৎসা সংকটে চরম বিপর্যস্ত গাজা। এরই মধ্যে ঠান্ডা এবং অব্যাহত হামলায় আরও ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়েছে উপত্যকাটি। সোমবার এক প্রতিবেদনে আল-জাজিরা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ইসরাইলের হামলা থামেনি। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এক মাসে ২৩৬ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৬০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। সোমবার পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় তিনজনের মৃত্যু ও ধসে পড়া ভবন থেকে আরও তিনজনের লাশ উদ্ধারের খবর দিয়েছে গাজার হাসপাতালগুলো। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে ধসে যাওয়া বাড়ি-ঘরের ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও ৫০০ ফিলিস্তিনির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা সবাই ইসরাইলের দুই বছরের টানা বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার। রোববার ফিলিস্তিনের সরকারি মিডিয়া অফিস অভিযোগ করেছে, গাজায় গত ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান যুদ্ধবিরতির মধ্যে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৯৪ বার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে ইসরাইলি বাহিনী। সংস্থাটির পরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতেহ আনাদোলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, এসব লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে তথাকথিত ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করে সামরিক অনুপ্রবেশ, গুলি ও গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ, তাঁবু ও মোবাইল হোম গাজায় প্রবেশে বাধা দেওয়া। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করেছিলাম এই চুক্তি কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনবে, কিন্তু তা হয়নি। ইসমাইল বলেন, তাদের অফিস এই লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের কাছে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে।
আরও ৩ জিম্মির লাশ ফেরত দিল হামাস
ইসরাইলকে আরও তিন জিম্মির লাশ ফেরত দিয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। রোববার রাতে লাশগুলো রেডক্রসের হাতে তুলে দেয় তারা। এরপর রেডক্রসের সদস্যরা মৃত জিম্মিদের লাশ ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রেডক্রসের মাধ্যমে ইসরাইল তিন মৃত জিম্মির কফিন গ্রহণ করেছে। যেগুলো গাজায় থাকা প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা শিনবেতের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্তে লাশগুলো শনাক্ত কেন্দ্রে পাঠানো হবে।’ হামাসের সশস্ত্র শাখা এর আগে জানায়, রোববার সকালে দক্ষিণ গাজার একটি সুড়ঙ্গ থেকে তারা লাশগুলো উদ্ধার করেছে।

          
                    