রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

নিউইয়র্কে জোহরান ম্যামদানির বিজয়ঃ তারুণ্যের রাজনীতির নতুন দিগন্ত

বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

নিউইয়র্কের রাজনীতিতে ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে যা ঘটল, তা ছিল এক রাজনৈতিক ভূমিকম্প। সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোর মতো প্রভাবশালী নেতাকে হারিয়ে ৩৩ বছর বয়সী প্রগতিশীল রাজনীতিক জোহরান ম্যামদানি উঠে এলেন নগরবাসীর প্রার্থী হিসেবে। এই জয় নিউইয়র্কের জন্য বড় একটি রাজনৈতিক ঘটনা। এটি প্রজন্মের, মনোভাবের এবং মূল্যবোধের পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

জোহরান ম্যামদানি ছিলেন না কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী, ছিল না তার পেছনে কর্পোরেট ডলার। তবে ছিল একদল তরুণ স্বপ্নবান মানুষ, যারা রাজনীতিতে ন্যায়, অন্তর্ভুক্তি এবং প্রগতির একটি নতুন রূপ দেখতে চায়। তাদের হাত ধরেই গড়ে ওঠে গ্রাসরুটস ক্যাম্পেইন, যা গৃহভাড়া নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক অধিকার, অভিবাসীদের মর্যাদা ও জলবায়ু ন্যায়বিচারের মতো ইস্যু সামনে এনেছে। তিনি ছিলেন সেই প্রার্থী, যিনি ‘পার্ক অ্যাভিনিউ’ নয়—‘জ্যাকসন হাইটস’ ঘুরেছেন। যিনি করপোরেট ডিনারের বদলে এসেছেন মসজিদ মন্দিরের দরজায়, ট্রেন স্টেশনে, শ্রমজীবী মানুষের ভিড়ে।

অ্যান্ড্রু কুয়োমো দীর্ঘদিন নিউইয়র্ক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তিনি দক্ষ প্রশাসক, তুখোড় কৌশলী, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং কোভিডকালে নার্সিংহোম মৃত্যুসংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে তার রাজনৈতিক পুঁজি ধ্বসে পড়ে। তার প্রার্থীতা অনেকটাই ছিল ‘কমব্যাক’ প্রচেষ্টা। কিন্তু ভোটাররা হয়তো বুঝিয়ে দিয়েছেন—নতুন প্রজন্ম আর আগের নেতাদের ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ দিতে আগ্রহী নয়। তারা নতুন মুখ খুঁজছে, বিশ্বাসযোগ্যতা খুঁজছে।

২০২৫ সালের এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং (RCV) পদ্ধতি। এখানে দ্বিতীয় পছন্দের ভোটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তৃতীয় স্থান পাওয়া প্রার্থী ব্র্যাড ল্যান্ডারের সমর্থকদের দ্বিতীয় পছন্দ ম্যামদানি হওয়ায়, তিনি শেষ রাউন্ডে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

নির্বাচনের আগে অ্যাক্টিভিস্ট সংস্থা DSA, রেপ. আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ এবং বার্নি স্যান্ডার্সের মতো নেতার সমর্থন ম্যামদানির দিকে তরুণ ও বামঘেঁষা ভোটারদের টেনে এনেছে। নিউইয়র্কের তৃনমূল নাগরিক সংগঠন ‘ক্যাভ ভয়েস’, ড্রামসহ এমন অন্যান্য সংগঠন ব্যাপকভাবে স্থানীয় সব ইস্যুকে জাগ্রত করত এ নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছে। ভোটারদের এ জাগরণ ম্যামদানির পক্ষে গিয়েছে।

নভেম্বরে লড়াই হবে তিন প্রার্থীর মধ্যে—জোহরান ম্যামদানি (ডেমোক্র্যাট), এরিক অ্যাডামস (স্বতন্ত্র), অ্যান্ড্রু কুয়োমো (ফাইট এন্ড ডেলিভার পার্টি)। এই ত্রিমুখী সংঘর্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

এরিক অ্যাডামস, যিনি নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা এবং বর্তমানে মেয়র, তিনি মূলত আইনশৃঙ্খলা, হাউজিং উন্নয়ন ও অবকাঠামো সংস্কার নিয়ে প্রচারণা চালাবেন। কুয়োমো আসবেন অভিজ্ঞতা ও মধ্যপন্থী উন্নয়নমুখী রাজনীতির বার্তা নিয়ে। ডেমোক্র্যাটদের ভোট ব্যাংকই তাদের রাজনীতির ভিত্তি।
তিনজন প্রার্থীই মূলত ডেমোক্র্যাটিক ঘরানার। তাই ভোট বিভাজনের আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল। এতে করে বিজয় নির্ধারিত হবে এক চমকপ্রদ প্রতিযোগিতায়—হয়তো খুব কম ভোটের ব্যবধানে।

ম্যামদানির বড় শক্তি তার বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রাসরুট কানেকশন এবং তরুণদের ভোট। তবে তার দুর্বলতা হচ্ছে—বড় ব্যবসায়ী বা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা নেই, মিডিয়া কাভারেজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এবং এখনো অনেক প্রবীণ ভোটারের কাছে অচেনা মুখ। এছাড়াও তাঁকে ধর্ম পরিচয় বা জাতীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করার প্রচারণাও নির্বাচনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে ম্যামদানি যদি তার বার্তা স্পষ্ট রাখতে পারেন—‘নতুন নিউইয়র্ক গড়তে চাই, যেখানে সকলের জন্য ন্যায়বিচার থাকবে’—তাহলে তিনি নভেম্বরেও বড় চমক দিতে পারেন।

ম্যামদানির জয় একজন অভিবাসী পটভূমির তরুণ প্রার্থীর উত্থানের চেয়েও বেশি । এটি আমেরিকান রাজনীতিতে বহুসাংস্কৃতিক বাস্তবতার স্বীকৃতি। তিনি একদিকে মুসলিম, অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয়, একই সঙ্গে নিউইয়র্কবাসীর প্রতিনিধি—এই পরিচয়টিই হয়তো তাকে ভবিষ্যতের ‘নতুন মুখ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

নিউইয়র্কের এই নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে—রাজনীতি আর কেবল পুঁজির খেলা নয়। এটি এখন বার্তার খেলা, মানুষের সংযোগের খেলা। জোহরান ম্যামদানি এই মুহূর্তে ২০২৫ সালের নিউইয়র্ক শহরের রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার জয় ঘরের ছেলের, অভিবাসীর, শ্রমজীবী মানুষের, তরুণ প্রজন্মের—এবং সেই স্বপ্নবাজদের যারা মনে করে, সত্যিকার পরিবর্তন সম্ভব। নভেম্বরের ভোটে সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তব হবে—সেই উত্তরের জন্য অপেক্ষায় থাকবে নিউইয়র্ক সিটি।