শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

শিরোনাম

মাছ ধরার নৌকার ছদ্মবেশে যেভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে চীন

শুক্রবার, অক্টোবর ৩১, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

তাইওয়ান প্রণালীর জলরাশিতে এখন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। দৃশ্যত শান্ত সমুদ্র, কিন্তু এর নিচে ঘনীভূত হচ্ছে এক নতুন ধরনের উত্তেজনা যা না যুদ্ধ, না সম্পূর্ণ শান্তি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর সাম্প্রতিক গবেষণা এই “নিঃশব্দ সংঘাতের” রূপরেখা তুলে ধরেছে।

তাদের অনুসন্ধান বলছে, চীন বর্তমানে অসংখ্য বেসামরিক মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করছে সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে, যাকে বলা হয় gray-zone operations অর্থাৎ এমন কার্যক্রম যা যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধের ছায়া তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ক্লান্ত ও নিরস্ত করতে চায়।

এই গবেষণার জন্য সিএসআইএস বিশ্লেষক দল ৩১৫টি চীনা পতাকাবাহী মাছ ধরার জাহাজের জিপিএস ও এআইএস-এর সংকেত ট্র্যাক করেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে তারা দেখতে পেয়েছে, অন্তত ১২৮ থেকে ২০৯টি জাহাজ সন্দেহজনক আচরণ করছে। তাদের নৌচলাচলের বড় অংশই সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকার আশেপাশে, অথচ প্রকৃত মাছ ধরার জলসীমায় তাদের উপস্থিতি নগণ্য।

আরও রহস্যজনক বিষয় হলো, ২০০-এর বেশি জাহাজ নিয়মিতভাবে এআইএস সংকেত বন্ধ রাখছে যা আন্তর্জাতিক নৌচলাচল আইনের দৃষ্টিতে স্পষ্ট লঙ্ঘন। এক নৌযান তো এক বছরে ১১টি ভিন্ন পরিচয় নম্বর ব্যবহার করেছে এবং প্রায় ১,৩০০ বার নিজের সিগন্যাল বদলেছে যেন নিজের ছায়াকেও বিভ্রান্ত করতে চায়।

প্রতিবেদনটি ইঙ্গিত করে যে, এসব নৌযানের অনেকই আসলে চীনের মারিটাইম মিলিশিয়া-র নিয়ন্ত্রণে। নামমাত্র বেসামরিক হলেও এই বাহিনী কার্যত পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) অনানুষ্ঠানিক শাখা। তারা সমুদ্রে বাণিজ্যিক পোশাকে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু বাস্তবে নজরদারি, বাধা সৃষ্টি ও প্রতিপক্ষের নৌচলাচলে ভয় দেখানোই তাদের লক্ষ্য।

সাম্প্রতিক Joint Sword-2024A ও 2024B মহড়ার সময়ও এসব জাহাজের অস্বাভাবিক গতিবিধি ধরা পড়েছে।

সিএসআইএস মনে করে, এই গ্রে-জোন কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাইওয়ানের ওপর ক্রমাগত মনস্তাত্ত্বিক চাপ বজায় রাখা। বেইজিং জানে, সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনবে। তাই তারা এমন এক মধ্যবর্তী কৌশল বেছে নিয়েছে যেখানে প্রকাশ্য যুদ্ধ নয়, বরং ভয়, বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তার মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়।

প্রতিবেদনটি আরও বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এখন এই জাহাজগুলোর কর্পোরেট মালিকানা নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এগুলো শেল কোম্পানির নামে নিবন্ধিত যেগুলো আসলে চীনের সামরিক বাহিনীর গোপন বিনিয়োগে পরিচালিত।

গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন পুনরাবৃত্ত অপরাধে জড়িত এসব জাহাজের মালিক, বীমাকারী ও অপারেটরদের কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাতে চীনের এই গোপন কর্মকাণ্ডের “অস্বীকারযোগ্যতা” বা deniability-এর সুযোগ কমে যাবে।

অন্যদিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, গত এক বছরে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি প্রায় তিন হাজারের বেশি উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা অতিক্রম করে এবং দুই হাজারের মতো জাহাজ প্রবেশ করেছে তাদের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে।

এই সংখ্যা ইঙ্গিত দেয় যে, সমুদ্রের নিচে কেবল মাছই নয়, ঘুরে বেড়াচ্ছে কৌশল, নজরদারি ও প্রভাব বিস্তারের তরঙ্গ।

চীনের এই সামুদ্রিক কৌশল নতুন কিছু নয়, তবে এর ব্যাপ্তি ও সূক্ষ্মতা এখন নজিরবিহীন। কয়েক দশক আগে যেখানে যুদ্ধ মানেই ছিল বন্দুকের গর্জন, এখন সেখানে বাণিজ্যিক জাহাজ, তথ্য-নেটওয়ার্ক আর সামুদ্রিক পথই হয়ে উঠছে অস্ত্র। ‘মাছ ধরার নৌকা’-র ছদ্মবেশে চীন কার্যত নতুন শীতল যুদ্ধের মঞ্চ তৈরি করছে, যেখানে প্রতিটি তরঙ্গই রাজনৈতিক সংকেত, প্রতিটি নৌচলাচলই সম্ভাব্য সংঘাতের দূত।

এই প্রেক্ষাপটে তাইওয়ান তাদের নজরদারি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। তারা দীর্ঘ-পাল্লার মানববিহীন যান তৈরি করছে, যাতে থাকবে উচ্চ-রেজোলিউশনের অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড সেন্সর এবং উন্নত রাডার ব্যবস্থা। লক্ষ্য একটাই চীনের এই গোপন অভিযানের প্রতিটি তরঙ্গ পড়ে ফেলা, এবং সার্বভৌমত্বের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায় প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই ‘নিঃশব্দ যুদ্ধ’ কোথায় গিয়ে থামবে? সমুদ্রের বুকে যখন জাল ফেলা হয়, তখন তা শুধু মাছ ধরার জন্য নয়, কখনো কখনো গোটা ভূরাজনৈতিক সম্পর্ককেই জালে জড়িয়ে ফেলে। আজ তাইওয়ান প্রণালী, কাল দক্ষিণ চীন সাগর, আর পরশু