বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

২০২৫ সালের মৌসুমী বায়ুর অস্বাভাবিক হিমালয় পেরোনো যাত্রা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

মিহিরকান্তি চৌধুরী: ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম এশিয়ার সবচেয়ে স্থায়ী জলবায়ুগত ধরনগুলোর একটিকে চ্যালেঞ্জ করে এক চমকপ্রদ ঘটনা উপহার দিল। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু—যা একশ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন ও কৃষিকে সংজ্ঞায়িত করে—মনে হলো যেন হিমালয়ের বিশাল প্রাচীর অতিক্রম করে তিব্বতি মালভূমিতে পৌঁছে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সুবিশাল পর্বতমালা প্রায় অপ্রবেশ্য দেয়াল হিসেবে কাজ করেছে, ভারত মহাসাগরের উষ্ণ, আর্দ্র বায়ুকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিতে বৃষ্টি বর্ষণ করতে বাধ্য করেছে। পাহাড়ি রিজের ওপারে তিব্বত সবসময় রুক্ষ, শুষ্ক আর ঝড়ো বাতাসের এলাকা হয়ে থেকেছে। অথচ ২০২৫ সালে স্যাটেলাইট চিত্র ও বায়ুমণ্ডলীয় পর্যবেক্ষণে ইঙ্গিত মেলে যে অস্বাভাবিক আবহাওয়াগত গতিশীলতার সাহায্যে মৌসুমি মেঘ এই বিভাজন ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে।

হিমালয়ের প্রাচীর এবং এর স্বাভাবিক ভূমিকা:

হিমালয় শুধু বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশ্রেণি নয়; এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ুগত উপাদানও বটে। মৌসুমী বায়ুর অস্তিত্বের মূলেই রয়েছে এর উপস্থিতি। প্রতি গ্রীষ্মে ভারত মহাসাগর গরম হলে আর্দ্র বাতাস উত্তর দিকে ধাবিত হয়। হিমালয়ের আকস্মিক দেওয়ালের মুখোমুখি হলে এই বাতাস বাধ্য হয় ওপরে উঠতে। সেই উত্থানের ফলে বায়ু ঠান্ডা হয়, জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়, এবং ভারতের সমভূমি, নেপাল ও ভুটানে প্রবল বর্ষণ নামে। কিন্তু বাতাস যখন চূড়া টপকে যায়, তখন তার আর্দ্রতার বড় অংশ হারিয়ে ফেলে, ফলে তিব্বত শুষ্ক ও বৃষ্টিহীন থাকে। এই তীব্র বৈসাদৃশ্যই সভ্যতাকে আকার দিয়েছে—দক্ষিণে উর্বর সমভূমি ও নদী উপত্যকা, আর উত্তরে শুষ্ক মালভূমি।

২০২৫ সালের ভাঙন: এক বিরল অতিক্রম:

২০২৫ সালে এই ভারসাম্য যেন কেঁপে উঠেছিল। আর্দ্রতা হিমালয়ের চূড়ায় থেমে যায়নি। বরং তা ছড়িয়ে পড়েছিল হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও লাদাখ জুড়ে, এবং এরপর অগ্রসর হয়েছিল তিব্বতের দিকে। অনেক বিজ্ঞানীর কাছে এটি ইঙ্গিত দেয় যে হিমালয়—যা এতদিন জলবায়ুর প্রাচীর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে—ঠিক পরিস্থিতিতে ভেদ্য হয়ে উঠতে পারে।

পশ্চিমী বিপর্যয়ের ভূমিকা:

একটি বড় কারণ ছিল মৌসুমী বায়ু ও পশ্চিমী বিপর্যয়ের (Western Disturbances) পারস্পরিক ক্রিয়া। এই বিপর্যয়গুলো মূলত ভূমধ্যসাগর ও মধ্য এশিয়ায় জন্ম নেয় এবং সাধারণত পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়, পশ্চিম হিমালয়ে শীতকালীন বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। কিন্তু ২০২৫ সালে এমন এক বিপর্যয় মৌসুমীর সর্বোচ্চ শক্তির সময়ের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এই বিপর্যয় যেন এক লিভারের মতো কাজ করেছিল, আর্দ্র বায়ুকে স্বাভাবিকের তুলনায় আরও উত্তরের দিকে টেনে নিয়েছিল এবং পর্বতমালার ওপারে এক নতুন পথ খুলে দিয়েছিল।

অ্যাডভেকশন: চলমান আর্দ্রতা:

অ্যাডভেকশন (Advection)—অর্থাৎ বাতাস ও জলীয়বাষ্পের আনুভূমিক পরিবহন—ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মৌসুমি বায়ু হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে উঠে যায় এবং সেখানে শক্তি খরচ করে ফেলে। কিন্তু ২০২৫ সালে অ্যাডভেকশন আর্দ্র বায়ুর স্রোতগুলোকে সরাসরি পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে নিয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমী বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট চাপের পার্থক্য এই পরিবহনকে আরও জোরদার করেছিল, ফলে বাতাস তাদের আর্দ্রতা ধরে রেখেই তিব্বতি মালভূমিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার বদলে, এই স্রোতগুলো আরও তীব্র হয়েছিল, অস্বাভাবিক আবহাওয়াগত সমন্বয়ের কারণে এক বিরল ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করতে পেরেছিল।

ভূ-প্রকৃতিগত প্রবেশদ্বার:

হিমালয় ভয়ংকর এক পর্বতশ্রেণি হলেও তা পুরোপুরি অটুট নয়। সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর গভীর উপত্যকা, আর লাদাখ ও অরুণাচল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা উচ্চ গিরিপথগুলো এই প্রাচীরকে ছেদ করেছে। সাধারণ বছরে এসব ফাঁকফোকর বর্ষার ছায়া-প্রভাব (Rain Shadow Effect) বদলাতে খুব একটা ভূমিকা রাখে না। কিন্তু ২০২৫ সালে শক্তিশালী মৌসুমি বায়ুর স্রোত এবং সক্রিয় অ্যাডভেকশনের প্রভাবে এই প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বারগুলো কার্যকরী চ্যানেলে পরিণত হয়। আর্দ্রতা সেগুলোর ভেতর দিয়ে গলে গিয়েছিল, এমন সব অঞ্চলে পৌঁছে যা সচরাচর গ্রীষ্মকালের বৃষ্টি দেখে না।
এক অতি শক্তিশালী মৌসুমী বায়ুর চাপ

আরেকটি উপাদান ছিল ২০২৫ সালের মৌসুমি বায়ুর তীব্রতা। ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের উষ্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠ তাপমাত্রা মৌসুমী ব্যবস্থাকে অস্বাভাবিক মাত্রার জলীয়বাষ্পে ভরিয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত আর্দ্রতা যেন এক প্রেসার কুকারের মতো কাজ করে, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি নিয়ে হিমালয়ের প্রাচীরকে আঘাত করতে থাকে। যেখানে দুর্বল মৌসুমি বায়ু ব্যর্থ হতো, সেখানে ২০২৫ সালের মৌসুমী বায়ু এগিয়ে গিয়েছিল, সাধারণত যে রিজগুলো তাকে আটকে রাখে সেগুলোকে অতিক্রম করে।

প্রভাব: পরিবর্তনশীল জলবায়ুর এক ধাঁধা:

তিব্বতে মৌসুমী বায়ুর প্রবেশ কেবলমাত্র আবহাওয়াবিদ্যার এক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা নয়; এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। মালভূমিতে পৌঁছানো আর্দ্রতা তুষার সঞ্চয়ের ধরন ও হিমবাহের গতিশীলতা পাল্টে দিতে পারে—কোথাও গলন দ্রুততর করতে পারে, আবার কোথাও তুষারপাত বাড়াতে পারে। তিব্বতি মালভূমিই এশিয়ার মহানদীগুলোর উৎস—সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং এবং ইয়াংজি। এখানে বৃষ্টিপাতের সামান্য পরিবর্তনও নিম্নগতির অঞ্চলে ঢেউ তোলে, প্রভাবিত করে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন।

এই ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রশ্নও উত্থাপন করে। এটি কি শুধুই একবারের কাকতালীয় ঘটনা—মৌসুমি স্রোতের উত্থান ও পশ্চিমী বিপর্যয়ের অস্বাভাবিক সময়মিলনের ফল? নাকি এটি বৃহত্তর এক রূপান্তরের পূর্বলক্ষণ, যেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৌসুমীর তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে এবং দীর্ঘস্থায়ী আবহাওয়ার সীমানাগুলো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে? যদি এ ধরনের ঘটনা আরও ঘন ঘন ঘটতে শুরু করে, তবে এশিয়ার পানি-নিরাপত্তা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
অস্পষ্টতা ও সামনে পথচলা

উত্তেজনার মাঝেও অনিশ্চয়তা থেকে গেছে। তিব্বতে প্রবেশ করা আর্দ্রতা কি সত্যিই উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছিল, নাকি তা কেবল মেঘাচ্ছন্নতা ও সামান্য বৃষ্টিপাতেই সীমাবদ্ধ ছিল? এই আর্দ্রতা মালভূমির কতদূর পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল, এবং স্থানীয় বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার সঙ্গে কেমনভাবে পারস্পরিক ক্রিয়া করেছিল? আবহাওয়াবিদরা এখনো স্যাটেলাইট তথ্য, বায়ুমণ্ডলীয় মডেল ও স্থলভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।

তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, এই ঘটনার প্রতীকী তাৎপর্য বিশাল। ২০২৫ সালে মৌসুমি বায়ু বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে জলবায়ু স্থির নয়, এবং সঠিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাচীরও বাঁকতে পারে। হিমালয়, যাকে প্রায়ই চিরন্তন ও অনড় হিসেবে দেখা হয়, দেখিয়েছে যে এটি আসলে এক গতিশীল ব্যবস্থার অংশ—সমুদ্রের তাপ, বায়ুপ্রবাহ এবং মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম।

এই মুহূর্তে ২০২৫ সালের সেই অতিক্রম একসাথে রহস্য ও সতর্কবার্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। রহস্য, কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কোন কোন প্রক্রিয়া একে সম্ভব করেছে। আর সতর্কবার্তা, কারণ যদি এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটতে শুরু করে, তবে এশিয়ার জলসম্পদের সূক্ষ্ম ভারসাম্য—যার উপর কোটি কোটি মানুষের জীবন নির্ভরশীল—এক নতুন এবং অনিশ্চিত অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারে।