থাইরয়েড হলো শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি, যা মেটাবলিজম ও হরমোনের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই গ্রন্থির কার্যকারিতা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে শরীরে দেখা দেয় নানা উপসর্গ— কারো ওজন হঠাৎ বাড়তে শুরু করে, কারো আবার কমে যায়। দেখা দেয় অতিরিক্ত ক্লান্তি, দুর্বলতা, মনোযোগে সমস্যা, এমনকি ত্বক ও চুলেও পরিবর্তন আসে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে থাইরয়েডের জটিলতা বাড়তে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, থাইরয়েডের চিকিৎসা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি। তবে সঠিক খাবার ও জীবনযাপনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো থাইরয়েডের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। চলুন একে একে জেনে নেওয়া যাক।
শরীরে থাইরয়েড সমস্যা তৈরি করা খাবার
১. সয়াবিন ও সয়াজাত পণ্য
সয়াবিন, টফু, সয়া দুধ প্রভৃতি খাবারে থাকে ফাইটোইস্ট্রোজেন ও গয়ট্রোজেন, যা থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক নিঃসরণে বাধা দিতে পারে।
২০১৫ সালে Journal of Clinical Endocrinology & Metabolism-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অতিরিক্ত সয়া গ্রহণ থাইরয়েডের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি তৈরি করে। ফলে হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই থাইরয়েড রোগীরা সয়া পণ্য খেলে তা যেন হয় সীমিত পরিমাণে।
২. গ্লুটেন
গম, ময়দা ও গ্লুটেনসমৃদ্ধ খাবার অনেক সময় থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে।
নিউট্রিয়েন্টস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্লুটেন অন্ত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট করতে পারে এবং এর প্রভাব গিয়ে পড়ে থাইরয়েড গ্রন্থির ওপর। অনেক বিশেষজ্ঞ থাইরয়েড রোগীদের জন্য গ্লুটেন-মুক্ত খাদ্যতালিকা (Gluten-free diet) পরামর্শ দেন, যাতে শরীরের হজমপ্রক্রিয়া ও হরমোন কার্যকারিতা স্বাভাবিক থাকে।
৩. প্রক্রিয়াজাত খাবার
চিপস, প্যাকেটজাত খাবার, প্রক্রিয়াজাত মাংস, ফ্রোজেন পিজা ইত্যাদিতে অতিরিক্ত সোডিয়াম বা লবণ থাকে।
থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে (Hypothyroidism) এ ধরনের খাবার রক্তচাপ বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আবার অতিরিক্ত লবণ শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। তাই প্রক্রিয়াজাত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
৪. ফ্যাটযুক্ত ও তেলে ভাজা খাবার

ফাস্ট ফুড, বার্গার, ভাজা পোলাও, অতিরিক্ত তেলে ভাজা মাছ-মাংস—এসব খাবারে থাকা বেশি ফ্যাট থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা কমায়।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেমন অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো বা বাদামের তেল সীমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তেলেভাজা ও ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘমেয়াদে থাইরয়েডের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে।
৫. চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার

কেক, মিষ্টি, সফট ড্রিংক, মিষ্টান্ন ইত্যাদি চিনি সমৃদ্ধ খাবার শরীরের ইনসুলিন ও হরমোনের ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করে।
২০১৮ সালে Endocrinology & Metabolism Clinics of North America-এ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত চিনি বিপাকক্রিয়া ধীর করে এবং থাইরয়েড রোগীদের আরও দুর্বল করে তোলে। পাশাপাশি এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে।
৬. নির্দিষ্ট কিছু ফল ও শস্য
স্ট্রবেরি, চিনাবাদাম ও বাজরা (Millet) জাতীয় শস্যে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান থাকে, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। এ কারণে থাইরয়েডের রোগীরা এসব খাবার খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সুস্থ থাকার জন্য টিপস

থাইরয়েড রোগীরা বেশি করে আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার (সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ) খেতে পারেন।
ভিটামিন ডি ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন—ডিম, বাদাম, সূর্যের আলোতে থাকা থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে।
সুষম ডায়েট, নিয়মিত শরীরচর্চা ও পর্যাপ্ত ঘুম থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখে।
যেকোনো খাবার সীমিত পরিমাণে খাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
শেষ কথা
থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ যেমন প্রয়োজন, তেমনি খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাবার বেছে নিলে এ রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই সয়াবিন, গ্লুটেন, প্রক্রিয়াজাত খাবার, তেলে ভাজা ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত চিনি থেকে দূরে থাকাই ভালো। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিন, তাহলেই থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং জীবন হবে সুস্থ ও স্বাভাবিক।


