নিয়মিত ব্যায়ামে অনেকাংশ ক্যানসারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। ক্যানসার একটি প্রাণঘাতী রোগ, যেখানে শরীরের কোষগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনিয়মিতভাবে বাড়তে থাকে এবং অস্বাভাবিক টিস্যুর সৃষ্টি করে। চিকিৎসা না হলে এসব টিস্যু আশেপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসার প্রতিরোধে ওষুধ বা চিকিৎসার পাশাপাশি আমাদের জীবনযাত্রার ধরনও গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত শরীরচর্চা ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে।
ব্যায়ামে কীভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়?

গবেষণায় যা জানা গেছে
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার এডিথ কোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রতিদিন মাত্র আধঘণ্টা ব্যায়াম করলে ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। শুধু তাই নয়, মাত্র একটি ব্যায়ামের সেশনই ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ধীর করতে সাহায্য করে। ব্যায়ামের পর শরীরে কিছু জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, যা ক্যানসারের কোষ বৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ক্যানসার সম্মেলনেও একই ধরনের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, স্টেজ ২ ও ৩ কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা নিয়মিত শরীরচর্চা চালিয়ে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে ক্যানসার পুনরায় ফিরে আসার হার অনেক কম ছিল। এ কারণে চিকিৎসকরাও এখন ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে শরীরচর্চা করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ব্যায়াম কীভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়?

গবেষকরা জানান, ব্যায়ামের সময় আমাদের শরীরের পেশি থেকে “মায়োকাইনস” নামক এক ধরনের প্রোটিন নিঃসৃত হয়। এই প্রোটিনের বিশেষ গুণ হলো এটি ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একবার ব্যায়াম করলেই শরীরে মায়োকাইনস তৈরি হতে শুরু করে এবং এটি ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে—যা ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
কোন ধরনের ব্যায়াম সবচেয়ে কার্যকর?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুটি ব্যায়াম পদ্ধতি ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে:
১. রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং (RT)
এ ধরনের ব্যায়ামে মূলত পেশি শক্তিশালী ও মজবুত হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- ডাম্ববেল বা কেটলবেল ব্যবহার
- ভারোত্তোলন
- স্কোয়াট, পুশ-আপ, প্ল্যাঙ্ক ইত্যাদি
এই ব্যায়ামগুলো দেহের পেশিকে সুস্থ রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
২. হাই-ইন্টেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং (HIIT)
এটি এমন এক ধরনের ব্যায়াম যেখানে অল্প সময়ে বেশি পরিশ্রম করা হয় এবং এর সঙ্গে ছোট বিরতির সমন্বয় থাকে। যেমন:
- ৩০ সেকেন্ড জাম্পিং জ্যাক, এরপর ১৫ সেকেন্ড বিশ্রাম
- ৩০ সেকেন্ড বার্পি বা স্কোয়াট জাম্প
প্রায় ২৫-৩০ মিনিটের এইচআইআইটি সেশনে শরীরে দ্রুত পরিবর্তন আসে এবং তাৎক্ষণিকভাবে মায়োকাইনস নিঃসৃত হয়।
ব্যায়ামের সময়সীমা ও নিয়ম
চিকিৎসক ও গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী—
- সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন, প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত।
- একটানা সময় না পেলে দিনভর ছোট ছোট সময়ে ভাগ করে হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করলেও উপকার পাওয়া যায়।
- শুরুর দিকে হালকা হাঁটা, দৌড়, যোগব্যায়াম বা সাইক্লিং শুরু করতে পারেন।
- ধীরে ধীরে রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং ও HIIT ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শেষ কথা
নিয়মিত ব্যায়াম শুধু ক্যানসার প্রতিরোধেই নয়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ আরও অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন, যেমন—সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত শরীরচর্চা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তাই প্রতিদিন অন্তত আধঘণ্টা ব্যায়ামকে অভ্যাসে পরিণত করুন—এটি হতে পারে ক্যানসারের মতো ভয়ঙ্কর রোগ প্রতিরোধের সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়।


