ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভরাডুবি হওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনেও বিপর্যয় ঠেকাতে পারেনি দলটির নীতিনির্ধারকরা।
জাকসু নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অঙ্কে চতুর্থ নম্বরে আছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থীরা। ২১টি ভোটকেন্দ্রের একটিতেও জয় পাননি তারা। এমনকি কোনো কোনো হলকেন্দ্রে মাত্র সাতটি ও আটটি ভোট পাওয়ার ঘটনা রয়েছে। একই অবস্থা এজিএস (পুরুষ) ও এজিএস (নারী) পদের দুই প্রার্থীরও। দলটির প্রার্থীরা জাকসুর ২৫টি পদের একটিতেও জয় পাননি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত এমন শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যর্থতা ও নেতিবাচক ইমেজের কারণে জাকসুতে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় নির্বাচন বর্জনের কারণেও দলটির ভোট কমেছে। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলেও বাগছাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে প্রগতিশীল দলগুলোর মধ্যেও কোন্দল তুঙ্গে। এই কোন্দলের বড় সুবিধা পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। পাশাপাশি সামাজিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব লাগাতার কর্মসূচি পালনের কারণেও অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছে ছাত্রশিবির। ফলে জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল রাজনীতির আধিক্য থাকা এই ক্যাম্পাসে ভোটে চমক দেখিয়েছে ইসলামপন্থি দলটি। এছাড়া শিবির বড় পদে থাকা নেতাদের চেয়ে সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত শিক্ষার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ায় তাদের জয় সহজ হয়েছে বলেও জানান তারা।
জাকসু নির্বাচন ও ফল মূল্যায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী যুগান্তরকে বলেন, সার্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ে তারা দলকে বড় করে দেখেনি। তারা ব্যক্তির ইমেজ ও কার্যক্রমকে বড় করে দেখেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের নির্বাচন। এখানে রাজনীতি যুক্ত হওয়া কাম্য নয়। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যা হচ্ছে তা কাম্য নয়।
৩৩ বছর পর জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৭ ঘণ্টা পর শনিবার বিকালে ফল ঘোষণা শুরু হয়। এ নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ আটটি প্যানেল অংশ নেয়। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট’র আংশিক প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। ওই সব প্যানেলের কেউ জাকসুর কোনো পদে জয়ী হননি। এ নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে জিএস, এজিএসসহ ২০টিতে ছাত্রশিবির, ভিপিসহ তিনটিতে স্বতন্ত্র ও দুটিতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) প্রার্থীরা জয়ী হন। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে বৃহস্পতিবারই নির্বাচন মনিটরিং টিমের তিনজন সদস্য, শুক্রবার নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার ও শনিবার আরেকজন নির্বাচন কমিশনার ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা পদত্যাগ করেন।
ঘোষিত ফলে দেখা গেছে, ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন। এ পদে সাত হাজার ৯৭০টি ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৬৪৮টি। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে মাত্র সাতটি ও আলবেরুনি হলে ১০টি ভোট পেয়েছেন তিনি। ২১নং ছাত্র হলে সর্বোচ্চ ৫৪টি ভোট পেয়েছেন। ভিপি পদে বাগছাসের প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল এক হাজার ২১১ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। দ্বিতীয় হয়েছেন ছাত্রশিবিরের আরিফ বিল্লাহ।
অপরদিকে জিএস পদে ছাত্রদলের প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী ৯৪১ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন। তিনি মেয়েদের আবাসিক হল জাহানারা ইমাম হলে মাত্র আট ভোট পেয়েছেন। এ পদে বাগছাস প্রার্থী আবু তৌহিদ মো. সিয়াম এক হাজার ২৩৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। ৩৯৩০ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবিরের মো. মাজহারুল ইসলাম। নির্বাচনে এমন ভরাডুবির জন্য ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংকে বড় কারণ বলে জানিয়েছেন ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী।
তারা বলেন, দলাদলির কারণে জনপ্রিয় নেতাকর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। প্যানেল দেরিতে ঘোষণা করায় প্রচারণার জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়নি। এছাড়া জাতীয়ভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, তার প্রভাবও পড়েছে এ নির্বাচনে।
ছাত্রদল সূত্র জানিয়েছে, জাকসু নির্বাচনের আগে কমিটি গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ১৭ আগস্ট ক্যাফেটেরিয়া এলাকায় এবং ১৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে দুগ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষ হয়। এছাড়া ৮ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বিবদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রদলের বর্ধিত ও হল কমিটি গঠনের পর থেকে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে হল কমিটিতে রাখা হয় সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী, মাদক ও ছিনতাইয়ে অভিযোগে বহিষ্কৃত, ভ্রুণ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তসহ নানা বিতর্কিত ব্যক্তিদের। কমিটি ঘোষণার পর ওইদিন রাতেই প্রতিবাদ মিছিল বের করেন শাখা ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এ প্রতিবাদের পর প্রায় ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেনি ছাত্রদলের শীর্ষ ‘সুপার ফাইভ’ নেতারা।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। তিনি বলেন, জাকসুতে আমাদের প্রার্থীরা না জিতলেও হল সংসদ নির্বাচনে ভিপি-জিএসসহ ৩৪ জন জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে কূটকৌশলের কারণে ছাত্রদলের প্রার্থীরা হেরে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, শিবিরের প্রার্থীরা সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় তাদের ব্যক্তিগত কিছু ভোট আছে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তারা শক্তিশালী নয়। তাদের ১৭ সদস্যের কমিটির সবাই একদিনও ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে মিছিল করতে পারেনি।
তবে ছাত্রদল ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর মধ্যে কোন্দলের সুযোগ নিয়ে ছাত্রশিবির বড় জয় পেয়েছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ইমন।
তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের দুই হাজার থেকে ২৫০০ জনের ভোটব্যাংক রয়েছে। এরসঙ্গে প্রার্থীদের ইমেজের কারণে আশপাশের কিছু ভোট পেয়ে তারা জয়ী হয়েছে। তাদের এই জয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে বামপন্থি সংগঠনগুলোর মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্টের একাধিক কমিটি রয়েছে। ছাত্রদলের নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং ও দলাদলি রয়েছে। এসব সংকটের কারণে নির্বাচনে সুবিধা পেয়েছে ছাত্রশিবির।
নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সরাসরি কারচুপির অভিযোগ করছি না। তবে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় চরম ত্রুটি ছিল, যে কারণে গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করেছে। আমরা পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে যাব।


