শরীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন অভাবে হতে পারে ঘুমের সমস্যা। ঘুম ঠিক না হলে আমরা মানসিক চাপ, ক্যাফেইন বা মোবাইল স্ক্রিনকে দায়ী করি। কিন্তু জানেন কি, আপনার খাওয়া-দাওয়া বা শরীরে কিছু ভিটামিনের ঘাটতি থাকলেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি হলে ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার সঠিকভাবে কাজ করে না।
আমরা সাধারণত এই সমস্যার কারণ হিসেবে মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ক্যাফেইন, মোবাইল ও টেলিভিশনের স্ক্রিনের নীল আলো কিংবা অস্বাস্থ্যকর জীবনধারাকে দায়ী করি। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু এগুলোই নয়, শরীরে কিছু নির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতিও ঘুমের মান নষ্ট করে দিতে পারে।
বিশেষ করে যেসব ভিটামিন ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলোর ঘাটতি হলে শরীরের স্বাভাবিক ঘুম-জাগরণ চক্র ব্যাহত হয়। এর ফলে একদিকে যেমন অনিদ্রা বাড়ে, অন্যদিকে ঘুমের মানও কমে যায়। চলুন জেনে নিই কোন ভিটামিনগুলো ঘুমে প্রভাব ফেলে এবং সেগুলো কোথা থেকে পাওয়া যায়।
ভিটামিন ডি – শরীরের ঘড়িকে ঠিক রাখে

ভিটামিন ডি সাধারণত হাড়ের জন্য প্রয়োজন বলে আমরা জানি। তবে এর আরেকটি বড় কাজ হলো ঘুম-জাগরণ চক্র বা সার্কাডিয়ান রিদম ঠিক রাখা। শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাবে মানুষ দিনে অস্বাভাবিকভাবে ঝিমুনি অনুভব করে, আবার রাতে ঘুম আসতে দেরি হয় কিংবা মাঝ রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের শরীরে ভিটামিন ডি কম থাকে, তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
প্রতিদিন অন্তত ১৫–২০ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকা ভিটামিন ডি-এর ভালো উৎস। এছাড়া ডিমের কুসুম, স্যামন মাছ, সার্ডিন, ফোর্টিফাইড দুধ এবং দই খেলে ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স – ঘুমের হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে
বি-ভিটামিন বিশেষ করে বি-৬, বি-১২ ও ফোলেট (বি-৯) ঘুমের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এগুলো মেলাটোনিন নামক ঘুমের হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। মেলাটোনিন ছাড়া আমাদের মস্তিষ্ক বুঝতেই পারে না কখন ঘুমাতে হবে আর কখন জেগে থাকতে হবে। তাই এই ভিটামিনের অভাবে অনিদ্রা, অস্থির ঘুম, বারবার স্বপ্ন দেখা এবং দিনের বেলায় অতিরিক্ত ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন বি পাওয়ার জন্য নিয়মিত ডাল, পালং শাক, ব্রকলি, গোটা শস্য, ডিম ও মাছ খেতে হবে। যারা নিরামিষাশী, তাদের জন্য বি-১২-এর ঘাটতি সাধারণত বেশি হয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া দরকার হতে পারে।
ভিটামিন সি – স্ট্রেস কমিয়ে ঘুম বাড়ায়

আমরা সবাই জানি ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তবে এটি ঘুমের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং স্নায়ুকে শান্ত রাখে। এর ফলে ঘুমের মান ভালো হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান, তাদের ঘুমের সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়। কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, কিউই, মরিচ, ব্রকলি এবং আমলকী ভিটামিন সি-এর চমৎকার উৎস।
ভিটামিন ই – মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে
ভিটামিন ই একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা মস্তিষ্কের কোষকে রক্ষা করে এবং হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিটামিন ই-এর ঘাটতি থাকলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে রাতে ঘন ঘন ঘুম ভাঙে এবং সকালে ক্লান্তি অনুভূত হয়।
ভিটামিন ই-এর ভালো উৎস হলো বাদাম, কাজুবাদাম, সূর্যমুখীর বীজ, জলপাই তেল ও সবুজ শাকসবজি। নিয়মিত অল্প পরিমাণে এগুলো খেলে শরীরে ভিটামিন ই-এর ঘাটতি পূরণ হয়।
ম্যাগনেসিয়াম – ঘুমের খনিজ

যদিও ম্যাগনেসিয়াম ভিটামিন নয়, এটি ঘুমের জন্য অপরিহার্য একটি খনিজ। ম্যাগনেসিয়াম মস্তিষ্ককে শান্ত করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে রিল্যাক্স করে। এর ঘাটতি হলে অনিদ্রা, উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং রাতে পেশিতে খিঁচুনি হতে পারে।
ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায় পালং শাক, কুমড়ার বীজ, আখরোট, ডার্ক চকোলেট ও গোটা শস্য থেকে। তবে অতিরিক্ত খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
শেষ কথা
ঘুমের সমস্যা মানেই শুধু মানসিক চাপ বা অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা নয়, শরীরে ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতিও এর বড় কারণ হতে পারে। তাই যদি নিয়ম মেনে চলেও আপনার ঘুমের সমস্যা থেকে যায়, তবে ভিটামিন ডি, বি-১২, ফোলেট ও ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
মনে রাখবেন, ভালো ঘুম কেবল অন্ধকার ঘর, আরামদায়ক বালিশ বা নিয়মিত শোবার অভ্যাসেই সীমাবদ্ধ নয়। শরীরে সঠিক ভিটামিন ও খনিজ থাকলে তবেই আপনি সহজে ঘুমাতে পারবেন, গভীর ঘুম পাবেন এবং সকালে উঠে নিজেকে সতেজ অনুভব করবেন।

