রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

নেপালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের দৃশ্যপট

শনিবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের জেন-জি আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে এক অপ্রত্যাশিত ঢেউ বয়ে এনেছিল। দীর্ঘদিন ধরে নেপালে আন্দোলন মানেই ছিল দলীয় নেতাদের পরিকল্পনা, তাদের স্লোগান এবং সংগঠনের ছকে আবদ্ধ প্রতিবাদ। কিন্তু এবারের গল্প ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আন্দোলনের সূচনা ঘটে ‘নেপোকিডস’ নামের এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা থেকেই।

প্রথমদিকে মনে হয়েছিল আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল কেপি ওলি সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু দিন গড়াতেই দেখা গেল, এটি শুধুমাত্র ডিজিটাল স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, এর মূলে রয়েছে আরও গভীর ক্ষোভ ও হতাশা।

হতাশা থেকে প্রতিবাদ

আন্দোলনের মূলে ছিল এক প্রজন্মের দীর্ঘদিনের অনুচ্চারিত হতাশা। বছরের পর বছর ধরে নেপালের তরুণরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এটি কেবল বৈশ্বিক গতিশীলতার অংশ নয় বরং এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে- নেপাল নিজেই তাদের প্রাপ্য সুযোগ, স্থিতিশীলতা ও আশার যোগান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই আন্দোলন ছিল বহুব্যাপ্ত এক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। চাকরির সুযোগ, মর্যাদা, দুর্নীতির অবসান এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই হয়ে উঠেছিল তরুণদের প্রধান মঞ্চ। যার মাধ্যমে তাদের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। তাদের বক্তব্য ছিল কেবল রাগ নয় বরং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ, ন্যায্য সুযোগের দাবি এবং বহুদিন ধরে অনুপস্থিত স্বচ্ছ নেতৃত্বের প্রত্যাশা।

সুশীলা কার্কির উত্থান

এই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফল ছিল- নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির উত্থান। অনেকের কাছে সুশীলা কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি জেন-জির রাজনৈতিক শক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় একীভূত করার প্রতীক। তবে তার নেতৃত্ব এসেছে এক অনিশ্চিত সময়ে। আশার প্রতীক হলেও প্রশ্ন রয়ে গেছ- তিনি কি প্রতীককে বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন? তার সরকার কি প্রকৃত সংস্কার আনতে পারবে? তিনি কি তরুণদের হতাশাকে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনে রূপান্তর করতে সক্ষম হবেন? নাকি তার শাসনকাল কেবল প্রতীকী এক পর্ব হয়ে ইতিহাসে থেকে যাবে?

আন্দোলন নিয়ে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মতো নেপালের জেন-জি আন্দোলন নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক এটিকে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল মনে করছেন। ইঙ্গিত করছেন, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো হয়তো অস্থিরতা উসকে দিতে ভূমিকা রেখেছে। অনেকে মনে করছেন, এটি মূলত অভ্যন্তরীণ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ষড়যন্ত্রের ফল। নেপালে রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে এমন সংশয় অস্বাভাবিক নয়। তবে এসব তত্ত্ব ছাপিয়ে আন্দোলনের প্রকৃত ভিত্তি নিহিত ছিল আরও গভীরে-দীর্ঘদিনের দমিয়ে রাখা তরুণ নেপালিদের ক্ষোভে। এই বিক্ষোভের মূল্য ছিল ভয়াবহ। ৫০ জনেরও বেশি তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন। শোকাহত হয়েছে অসংখ্য পরিবার। একইসঙ্গে সরকারি ভবন ও জনপরিকাঠামোর ক্ষতি মেরামতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি রুপি। দুর্বল অর্থনীতির ওপর নেমে এসেছে অতিরিক্ত চাপ। ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের স্বপ্ন দেখা নেপালের জন্য এই রক্তাক্ত জাগরণ অর্থপূর্ণ সংস্কারের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

বছরের পর বছর ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি

জেন-জি বিদ্রোহ বুঝতে হলে, ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাবের পর থেকে নেপালের রাজনৈতিক যাত্রার মূলে ফিরে যেতে হবে। বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, সংস্কারের নামে ভাঁওতা, দুর্নীতির দৌরাত্ম সব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মের মনে জন্ম দিয়েছে তীব্র সংশয়। তারা মনে করছে, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। জেন-জি আন্দোলন কোনো হঠাৎ বিস্ফোরণ নয় বরং এটি ছিল বছরের পর বছর ধরে জ্বলন্ত অভিযোগের এক অগ্ন্যুৎপাত।

গণমাধ্যম, ভুয়া খবর এবং তথ্য সংকট

গণমাধ্যমের দৃষ্টিকোণ থেকে, জেন-জি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতাও উন্মোচন করেছে, ভুয়া খবর এবং এআই-নির্মিত বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিস্তারের মাধ্যমে। যেখানে সংবাদপাঠকদের জন্য সত্য-মিথ্যা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। নেপালের প্রায় ৯০ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী মূলত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও এক্স (সাবেক টুইটার) এর মতো প্ল্যাটফর্মকেই তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে তারা ঐতিহ্যবাহী টিভি, রেডিও বা প্রতিষ্ঠিত অনলাইন সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলে। এই অতিনির্ভরতা আন্দোলনকে অস্থির করে তোলে। গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

কৌশলগত সন্ধিক্ষণে নেপাল

আজ নেপাল দাঁড়িয়ে আছে এক কৌশলগত সন্ধিক্ষণে। শুধু রাজনীতিতেই নয়, কূটনীতিতেও। দুই এশীয় পরাশক্তি ভারত ও চীনের মাঝখানে অবস্থান নেপালকে সবসময়ই নাজুক করেছে। তাই জেন-জি আন্দোলনকেও এই ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করেছে বা প্রভাবিত করেছে।

সামনে কী অপেক্ষা করছে

আগামী ছয় মাসের মধ্যে নেপালে নির্বাচন। সুশীলা কার্কির সরকারকে এখন থেকেই মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিশাল সব চ্যালেঞ্জ। পুরনো ও নতুন-উভয় রাজনৈতিক দলই এখনো দিশেহারা। তবে সব বিভ্রান্তির মাঝেও একটি বিষয় স্পষ্ট- অধিকাংশ নেপালি এখনও বিশ্বাস করে গণতন্ত্রই নেপালের জন্য সর্বত্তম ব্যবস্থা। তবে তারা শুধু নামমাত্র গণতন্ত্র চায় না, চায় কার্যকর গণতন্ত্র-যেখানে থাকবে জবাবদিহি, সুযোগ আর অন্তর্ভুক্তি।

লেখক পরিচিতি: নিমা কাফলে। নেপাল প্রেস কাউন্সিলের সদস্য