সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

শিরোনাম

কী এই বিরল খনিজ, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র–চীন শীতল যুদ্ধের আভাস

রবিবার, অক্টোবর ১২, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

গত বৃহস্পতিবার চীন তাদের বিরল খনিজ রপ্তানির ওপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করার পর, ট্রাম্প অর্থনৈতিক প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি আসন্ন এশিয়া সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিলও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধে এবার নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে ‘বিরল মৃত্তিকা’ খনিজ।

গত বৃহস্পতিবার চীন তাদের বিরল খনিজ রপ্তানির ওপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করার পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, আসন্ন এশিয়া সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিলও হতে পারে।

সিএনএন জানিয়েছে, বিরল খনিজ নিয়ে এই টানাপোড়েন অবশ্য বর্তমান প্রশাসনের আমলের নয়; বহু বছর ধরেই চীন কৌশলগত শিল্পনীতির অংশ হিসেবে এই খনিজগুলোর প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এপ্রিল মাসে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর যে ‘পাল্টা শুল্ক’ ঘোষণা করেছিলেন, চীনের এই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তার একটি জবাব হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

জেনেভায় বাণিজ্য যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর মার্কিন কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে চীন এই খনিজগুলোর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে।

কিন্তু কী এই বিরল খনিজ এবং কেন তা ট্রাম্পের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?

বিরল খনিজ বলতে পর্যায় সারণির ১৭টি ধাতব মৌলকে বোঝায়, যার মধ্যে স্ক্যান্ডিয়াম, ইট্রিয়াম এবং ল্যান্থানাইড সিরিজের ১৫টি মৌল (ল্যান্থানাম থেকে লুটেটিয়াম) অন্তর্ভুক্ত।

যদিও এদের নাম ‘বিরল খনিজ’, বাস্তবে এরা পৃথিবীর ভূত্বকে খুব কম দুর্লভ নয়, বরং সোনা থেকেও বেশি পরিমাণে এদের উপস্থিতি রয়েছে। তবে, সমস্যা হলো এদের নিষ্কাশন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত কঠিন, ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

স্মার্টফোন থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন, এলইডি লাইট এবং ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টিভির মতো দৈনন্দিন প্রযুক্তিতে বিরল মৃত্তিকা সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি, এমআরআই স্ক্যানার এবং ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য এই বিরল খনিজ অপরিহার্য। ২০১৫ সালের সিএসআইএস-এর একটি গবেষণা নোট অনুসারে, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, লেজার, স্যাটেলাইট এবং টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরও অনেক সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে এগুলোর ব্যবহার রয়েছে।

চীনের একাধিপত্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বিরল মৃত্তিকা খনিজ উৎপাদনের ৬১ শতাংশ আসে চীন থেকে। শুধু তাই নয়, প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে বৈশ্বিক উৎপাদনের ৯২ শতাংশই চীনের নিয়ন্ত্রণে।

বিরল খনিজ মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত – হালকা এবং ভারী – যা তাদের পারমাণবিক ওজনের ওপর নির্ভর করে। ভারী বিরল খনিজ অপেক্ষাকৃত দুর্লভ, এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, যুক্তরাষ্ট্র উত্তোলন করার পর এই খনিজগুলো পৃথকীকরণের সক্ষমতা রাখে না।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্রিটিক্যাল মিনারেলস সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক গ্রেসেলিন বাস্কারান জানান, ‘এই বছরের শুরু পর্যন্ত, ক্যালিফোর্নিয়ায় আমরা যত ভারী বিরল মৃত্তিকা উত্তোলন করতাম, তা পৃথকীকরণের জন্য চীনে পাঠানো হতো।’

তবে, এপ্রিল মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের চীনকে লক্ষ্য করে আকাশচুম্বী শুল্ক ঘোষণার পর এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। বাস্কারান বলেন, ‘বিরল খনিজ পৃথকীকরণের জন্য চীনের ওপর আমেরিকার নির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা চীন দেখিয়েছে।’ তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিরল মৃত্তিকার একটি মাত্র সক্রিয় খনি রয়েছে।

বাণিজ্য যুদ্ধে বিরল খনিজের গুরুত্ব ও চীনের নতুন পদক্ষেপ

বিরল খনিজ চীনের জন্য বাণিজ্য যুদ্ধে একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এই মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় এপিইসি সম্মেলনে শি জিনপিং এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের কথা থাকলেও, চীনের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞাকে বাণিজ্য যুদ্ধের এক বড় চাল হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক পদক্ষেপে চীন তাদের বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ তালিকায় আরও পাঁচটি বিরল খনিজ উপাদান – হলমিয়াম, এরবিয়াম, থুলিয়াম, ইউরোপিয়াম, ইটারবিয়াম, এবং সম্পর্কিত চুম্বক ও উপকরণ – যুক্ত করেছে, যার জন্য রপ্তানি লাইসেন্স আবশ্যক। এতে মোট নিয়ন্ত্রিত বিরল মৃত্তিকার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২।

এছাড়া, বিরল খনিজ উৎপাদন প্রযুক্তি দেশের বাইরে রপ্তানির জন্যও চীনের লাইসেন্স প্রয়োজন হবে।

তবে এবছর এই প্রথমবার নয় যে চীনের বিরল খনিজ নিষেধাজ্ঞা ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছে। গত জুন মাসে ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ বলেছিলেন যে চীন বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, কারণ বেইজিং সাতটি বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং সম্পর্কিত পণ্যের উপর তাদের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।

এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণগুলোর একটি বড় প্রভাব থাকতে পারে, কারণ বিরল মৃত্তিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরল খনিজ যৌগ এবং ধাতুর আমদানির ৭০ শতাংশ এসেছে চীন থেকে।

তবে, চীনের সর্বশেষ এই নিষেধাজ্ঞাকে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধে এক নাটকীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

গেল শুক্রবার ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে চীনের পদক্ষেপের আর্থিক পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হতে হবে। তারা যে প্রতিটি উপাদানকে একচেটিয়া করতে পেরেছে, আমাদের কাছে তার দ্বিগুণ আছে।’