বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

মারা গেছেন ইরাক আগ্রাসনের মূল পরিকল্পনাকারী ডিক চেনি

বুধবার, নভেম্বর ৫, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আফগানিস্তান ও ইরাক আগ্রাসনের অন্যতম স্থপতি ডিক চেনি মঙ্গলবার ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন।

তার পরিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চেনি নিউমোনিয়া ও হৃদ্‌যন্ত্র ও রক্তনালিজনিত জটিলতায় মারা গেছেন।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে মিডল ইস্ট আই।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‌‘দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ডিক চেনি আমাদের জাতির সেবা করেছেন—হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ, ওয়াইওমিংয়ের কংগ্রেসম্যান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আমাদের দেশের জন্য তার অবদানের প্রতি আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।’

চেনি ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৯ সালে, রিচার্ড নিকসনের প্রশাসনে ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সহযোগী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে।

চেনি ও রামসফেল্ডকে ১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নব্যরক্ষণশীল মতবাদের মূল স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মতবাদে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আগাম সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া বৈধ।

রামসফেল্ড হোয়াইট হাউস কাউন্সেলর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর চেনি তার ডেপুটি হন। পরের বছর রামসফেল্ড কস্ট অব লিভিং কাউন্সিলের পরিচালক হলে, চেনি তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৪ সালে জেরাল্ড ফোর্ডের প্রশাসনে তিনি প্রথমে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং পরে চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পান। এরপর তিনি ওয়াইওমিং থেকে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন এবং রোনাল্ড রিগানের প্রেসিডেন্সির সময় পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন।

‘ডেজার্ট স্টর্ম’ ও ইরাকবিরোধী যুদ্ধ

জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশের প্রেসিডেন্সির সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে চেনি ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের জোরালো সমর্থক ছিলেন।

তিনি সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহদকে রাজি করান, যাতে দেশটিতে ৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যায়, যা পরবর্তীতে গালফ ওয়ারের অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম নামে পরিচিত হয়।

স্থল অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মাত্র ১০০ ঘণ্টার মধ্যেই কুয়েত থেকে ইরাকি বাহিনীকে হটিয়ে দেয়।

বিল ক্লিনটন ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চেনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ. বুশ তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব দিলে, শেষ পর্যন্ত বুশই চেনিকে নিজের সহপ্রার্থী হিসেবে বেছে নেন।

রাজনীতিতে ফিরে আসার সময় চেনি তেল কোম্পানি হ্যালিবারটন থেকে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অবসর ভাতা পান, যেখানে তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী ছিলেন।

৯/১১–এর পর ‘ওয়ার অন টেরর’

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর চেনি মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে ‘শাসন পরিবর্তন’–এর আহ্বান জানান, যাতে যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।

তিনি প্রণয়ন করেন তথাকথিত ‘ওয়ান পারসেন্ট ডকট্রিন’ বা ‘চেনি ডকট্রিন’, যেখানে বলা হয়—যদি কোনো সম্ভাব্য হুমকি মাত্র এক শতাংশও থাকে, তবুও যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম হামলা চালাতে হবে।

২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বুশ প্রশাসন আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালায়, কারণ তারা আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছিল।

এর পর চেনি ২০০৩ সালের মার্চে ইরাক আক্রমণের পক্ষে অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি দাবি করেছিলেন, মার্কিন সেনাদের ‘মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানানো হবে’ এবং যুদ্ধ ‘সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হবে’—যদিও বাস্তবে তা প্রায় এক দশক স্থায়ী হয়।

বুশ প্রশাসনের দাবি ছিল, ইরাকের কাছে বিধ্বংসী অস্ত্ররয়েছে এবং সাদ্দাম হোসেন সেগুলো আল–কায়েদার মতো সংগঠনের হাতে তুলে দিতে পারেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়, এ দাবি ছিল মিথ্যা।

চেনি বন্দি সন্ত্রাসীদের ওপর ওয়াটারবোর্ডিংসহ নির্যাতনমূলক জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতিরও প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমাদের উন্নত জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলের দৃঢ় সমর্থক।’

ডিক চেনি আধুনিক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বিতর্কিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।