রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

যুক্তরাষ্ট্রের ইরান হামলা: ট্রাম্প ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর বার্তা

সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বার্তা ছিল একটাই—ইরানের সঙ্গে আলোচনায় ফিরতে চায় ওয়াশিংটন। পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। যুদ্ধ নয়, শান্তির মাধ্যমে সমাধান।

কিন্তু রবিবার হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়ে দিল। এবং ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখে বসলেন—‘রেজিম চেঞ্জ’ বা শাসন পরিবর্তনের কথা।

ট্রাম্পের ভাষায়, “রেজিম চেঞ্জ বলা হয়ত এখন সঠিক নয়, তবে যদি ইরানের বর্তমান সরকার ‘মেইক ইরান গ্রেট এগেইন’ করতে না পারে, তাহলে কেন শাসন পরিবর্তন হবে না?” সঙ্গে তিনি যুক্ত করলেন নতুন এক স্লোগান—“এমআইজিএ!!!”
এই বক্তব্য যেন তার প্রশাসনের আগের সকল বার্তার উপর একপ্রকার ধাক্কা। ট্রাম্পের এই পোস্টের কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছিলেন, “এই আক্রমণের লক্ষ্য কখনোই শাসন পরিবর্তন ছিল না।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিওও জানিয়ে রেখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা থেকে সরে আসে। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন—যদি ইরান প্রতিশোধ নেয় কিংবা পারমাণবিক কর্মসূচি জোরালোভাবে এগিয়ে নেয়, তবে শাসন ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে।

এমন দ্বৈত বার্তায় বিশ্বের নানা প্রান্তে এখন বিভ্রান্তি—যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়? আলোচনায় ফেরা, নাকি সংঘর্ষের নতুন অধ্যায়? পেন্টাগনের ভাষায়, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ ছিল নিখুঁত পরিকল্পিত এক আক্রমণ। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমার বহর, ফাইটার জেট এবং ডেকয় ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানের ফোরডো, নাটাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ভয়াবহ ক্ষতি করা হয়েছে।

জেনারেল ড্যান কেইন জানান, “তিনটি স্থাপনায় বিশাল ক্ষতি হয়েছে। ইরান আকাশে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হয়েছে।” ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের এই সাফল্যকে ‘উল্লেখযোগ্য সামরিক অর্জন’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, “আমরা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছি।”
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সাফল্য দীর্ঘমেয়াদে শান্তি আনবে, নাকি যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেবে?

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রাগে ফুঁসছেন। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সার্বভৌমত্বের বড় লঙ্ঘন করেছে। তারা আমাদের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে রেড লাইন অতিক্রম করেছে। এখনো আলোচনার জায়গা কতটুকু অবশিষ্ট আছে, সে নিয়ে আমি সন্দিহান।”

ইরান আরও হুমকি দিয়েছে, হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে। আঞ্চলিক মার্কিন ঘাঁটিগুলোর উপর হামলা, সাইবার আক্রমণ এবং পারমাণবিক কর্মসূচি আরও জোরালো করার মতো বিকল্পগুলো এখন তাদের হাতের মুঠোয়।

রাশিয়া, চীন, তুরস্ক—তিন শক্তিধর দেশই এই হামলার নিন্দা করেছে। রাশিয়া একে ‘আন্তর্জাতিক আইনের বড় লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। চীন কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা এবং ইতালি দ্রুত আলোচনা পুনরায় শুরু করার পক্ষে।

বিশ্ববাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তেলের দাম ইতোমধ্যে ২১ শতাংশ বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটে নেতিবাচক সাড়া পড়েছে। ট্রাম্পের মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি এখন বড় সংকটের মুখে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হেগসেথ জানান, ইরানকে ট্রাম্প ৬০ দিনের সময় দিয়েছিলেন আলোচনায় ফিরে আসার জন্য। ইরান সে সময়ের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।

ট্রাম্পের বার্তা ছিল স্পষ্ট—শান্তির জন্য ৬০ দিন, না হলে ‘বোমা’। তবে হেগসেথ বলেন, “এই সময়সীমা ট্রাম্প খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। ইরান বুঝে ফেলেছে ট্রাম্পের ৬০ দিন মানে ৬০ দিন।”

পেন্টাগনের তথ্য অনুযায়ী, বি-২ বোমার বহর মিসৌরি ঘাঁটি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল কৌশলগত বিভ্রান্তির জন্য। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ইরানের নজরে আসার আগেই তিনটি বড় পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়।

ট্রাম্প এই হামলার পর সমালোচকদের দিকেও কটাক্ষ ছুঁড়ে দেন। রিপাবলিকান প্রতিনিধি থমাস ম্যাসির বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ঝাড়েন, যিনি কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া হামলার প্রতিবাদ করেছিলেন।

ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “আমরা গতকাল অসাধারণ সামরিক সফলতা পেয়েছি। তাদের হাত থেকে ‘বোমা’ কেড়ে নিয়েছি। তারা সুযোগ পেলে এটা অবশ্যই ব্যবহার করত!”

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে এখন একটাই প্রশ্ন—এই হামলা কি ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনবে, নাকি মধ্যপ্রাচ্যের আরও ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বার খুলে দিল?

ট্রাম্প অতীতে বহুবার হুমকি দিলেও শেষ মুহূর্তে পিছু হটেছেন। এবার কি সেটাই হবে? নাকি ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে?

বিশ্ব তাকিয়ে আছে—যুদ্ধ নাকি শান্তি।