মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই বিশ্ব রাজনীতির এক অস্থির কেন্দ্র। সাম্প্রতিক ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা সেই অস্থিরতাকে আবারও সামনে এনেছে। জুন ২০২৫ সালের এই ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—এ কি বড় কোনো যুদ্ধের পূর্বাভাস, নাকি দুই শক্তির মধ্যে সাময়িক ক্ষমতার খেলা?
২৩ জুন বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল ইরানের প্রতিশোধমূলক এক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা। লক্ষ্য ছিল কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এই হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ২২ জুন পরিচালিত এক বড় সামরিক অভিযানের প্রত্যুত্তর। সেই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমারু বিমান ও টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামের আকস্মিক হামলা চালায়। ইরানের দাবি, এই হামলা তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
ইরানের পাল্টা জবাব ছিল সুপরিকল্পিত। কাতারের রাজধানী দোহায় ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। কাতারের নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র মাঝপথেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় কাতার সরকার জরুরি ভিত্তিতে তাদের আকাশপথ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
একই সময় ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের মার্কিন ঘাঁটি ‘আইন আল-আসাদ’-এও ইরান হামলা চালায়। ঘাঁটিটি আগেও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান দ্বন্দ্বে আলোচিত ছিল। তবে এই হামলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, কিছু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা গেলেও কিছু আঘাত পড়ে ঘাঁটির পার্শ্ববর্তী এলাকায়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এই হামলাকে ‘মার্জিত ও সফল প্রতিশোধ’ হিসেবে তুলে ধরে। প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান স্পষ্ট ভাষায় জানান, “আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি। তবে যদি আগ্রাসন চলতেই থাকে, তাহলে প্রতিরোধও চলবে।”
ইরান তাদের এই পাল্টা হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন টাইডিংস অব ভিকটরি’। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার পর পরিচালিত ‘অপারেশন মার্টির সোলাইমানি’র পর এটি ইরানের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধমূলক হামলা। নামকরণের মধ্যেই ইরান তাদের মনস্তাত্ত্বিক বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে—তারা বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দিতে চায়।
এই ঘটনায় শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেঁপে উঠেছে। কাতার ও ইরাক দ্রুত নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে এবং সম্ভাব্য আরও হামলার আশঙ্কায় সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করে। আন্তর্জাতিক মহলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে—এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি যদি সামলানো না যায়, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যের আরও বিস্তৃত যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান এই হামলার মাধ্যমে বিশ্বের সামনে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে—যদি তাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা শুধু প্রতিরক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সরাসরি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের অবস্থানে অনড়। তারা জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে আরও কঠোর জবাব দেওয়া হবে।
ঘটনার পরপরই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা এখনই বলা কঠিন। কূটনৈতিক আলোচনার পথ খোলা থাকলেও উভয় দেশের সামরিক প্রস্তুতি ও বাকযুদ্ধ ইঙ্গিত দেয়, তারা আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে।
বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল দীর্ঘদিনের বৈরিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতির কারণে এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের আগুন যদি সত্যি জ্বলে ওঠে, তাহলে তার আঁচ শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, সারা বিশ্বের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্প্রতিক হামলা-পাল্টা হামলা বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই উত্তেজনা কি কূটনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, নাকি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সংঘর্ষের দিকে এগোবে—সে উত্তর সময়ই দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, এই প্রতিশোধের গল্প আজ শুধু ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে।

